টিউলিপস টেরিটরি ঘুরে যা দেখা গেল : অনুসন্ধানে দুদক

টিউলিপস টেরিটরি ঘুরে যা দেখা গেল : অনুসন্ধানে দুদক

একুশে সিলেট ডেস্ক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর সদ্য সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের মা-বাবার নামে মিলেছে বিপুল সম্পদ। তারই একটি ‘টিউলিপস টেরিটরি’ নামের বিশাল বাগানবাড়ি। জৌলুস হারিয়ে টিউলিপস টেরিটরি যেন এখন এক ঝরা ফুলের বাগান। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চিহ্ন বাগানটির বিভিন্ন স্থানে। এ ছাড়া শেখ রেহানা ও তার পরিবারের সদস্যদের আরও তিনটি বিলাসবহুল বাংলো ও বাগানবাড়ির সন্ধান মিলেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কানাইয়া এলাকায় ‘টিউলিপস টেরিটরি’। শেখ হাসিনার ভাগ্নি যুক্তরাজ্যের সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের নামে ৩০ বিঘার বাগানবাড়িতে আছে বিশালাকার পুকুর, শানবাঁধানো ঘাট, অভিজাত ডুপ্লেক্স ও বাংলো।

টাইলসে মোড়ানো নামফলকে ইংরেজিতে লেখা ‘টিউলিপস টেরিটরি, কানাইয়া, গাজীপুর, ২৫ ডিসেম্বর ২০০৮’। রক্তরাঙা ফুলে মোড়ানো প্রধান ফটকের দেয়ালে লেখা বাগান বিলাস। কালো লোহার ফটক পার হয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখ আটকে যায় সারি সারি সুপারি বাগানে।

বাগানবাড়ির ভেতরে সারি সারি গাছের মাঝে পাকা রাস্তা ধরে ৫ থেকে ৭ মিনিট হেঁটে যাওয়ার পরই বিশালাকৃতির পুকুর। লাল টাইলসে মোড়ানো শানবাঁধানো ঘাট। ঘাটের পাশে বসার জন্য পাকা ছাউনি। পাশের আরেকটা পুকুর দেখতে দিঘির মতো বিশাল। রয়েছে স্পিডবোট। পুকুরের একপাশে ডুপ্লেক্স বাংলো। এ ছাড়া মূল ফটকের কাছে রয়েছে কেয়ারটেকার ও অন্যান্য কর্মচারীর থাকার স্থান। বাগানজুড়ে আম, নারকেল, সুপারি, কলা বাগানসহ বিভিন্ন ঔষধি ও বাগান বিলাস গাছের সমারোহ।

৫ আগস্টের পর ‘কৃত্রিম এই স্বর্গভূমি’ এখন অনেকটা পরিত্যক্ত। সরকার পরিবর্তনের পর হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে টিউলিপ টেরিটরিতে। ডুপ্লেক্স বাড়ির ভেতরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় পুড়ে গেছে আসবাব। জানালার কাচ ভাঙা, কাচের টুকরো পড়ে আছে এখানে-সেখানে। এ ছাড়া টিনশেডের ভবনে হামলায় ভেঙে গেছে দরজার লকার, জানালার কাচ। ভেতরে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে বিদ্যুৎ বিলের কপিসহ বিভিন্ন কাগজপত্র। পড়ে আছে ভাঙা ক্রেস্ট ও ছবি। পড়ে থাকা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে শেখ রেহানার স্বামী সফিক সিদ্দিককে।

দীর্ঘদিন মানুষের আনাগোনা না থাকায় বাগানজুড়ে জন্মেছে ঘাস ও লতাপাতা। রয়েছে বিভিন্ন শাকসবজির বাগান। এসব বাগানে চাষাবাদ করছেন এখানে কর্মরত কর্মচারীরা। দেখভালের জন্য আছেন চারজন কেয়ারটেকার। আর টিউলিপের বাবা সফিক আহমেদ সিদ্দিক মাঝেমধ্যে খোঁজখবর নেন।

কর্মচারীরা জানান, ৫ আগস্টের পর স্থানীয় কিছু লোক দেয়াল টপকে বাগানবাড়ির ভেতরে ঢুকে বাংলোতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। বাংলোতে থাকা সব মালপত্র তারা নিয়ে যায়। আগে সফিক সিদ্দিক, মেয়ে টিউলিপ, ছেলে ববি এলেও এখন কেউ আসেন না।

বাড়ির একজন কেয়ারটেকার বলেন, ‘এটা শেখ রেহানার স্বামী সফিক সাহেবের বাগান। আমরা এখানে চারজন আছি, যার মধ্যে একজন দারোয়ান। আমরা বাগানে কাজ করি, আমাদের বেতন প্রতি মাসে দেওয়া হয়।’

অন্য কেয়ারটেকার আব্দুর রহমান বলেন, ‘এটি সফিক স্যারের বাগানবাড়ি। তিন বিঘা জমি কেনার পর আস্তে আস্তে বাড়িয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে স্যার আসতেন। ভাঙচুর ও রাস্তা খারাপ থাকায় তিনি এখন আর আসেন না। শীতের মৌসুমে বছরে একবার টিউলিপ আপা, ববি ভাই আসেন।’

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তিন বিঘার বিরোধপূর্ণ একটি জমি কিনে টিউলিপস টেরিটরি বাগানবাড়ির কাজ শুরু করেন সফিক সিদ্দিক। পরে ধাপে ধাপে জমি কিনে বিরাটাকার বাগানবাড়ি তৈরি করা হয়। এখানে প্রতি বছর শীতের সময় শেখ রেহানা ছেলেমেয়ে ও নাতিনাতনিদের নিয়ে এই বাগানবাড়িতে আসতেন। বাগানের ভেতর বড় ডুপ্লেক্স বাংলোতে থাকতেন তারা। থাকত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আনাগোনা।

স্থানীয় লোকজন বলেন, একটা ‘গ্যাঞ্জাইমা’ জমি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সফিক সিদ্দিক কিনে নেন। এরপর আরও জমি কিনে বাগানবাড়ি করেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের কপিতে রয়েছে ড. সফিক সিদ্দিকের নাম। এ ছাড়া স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শেখ রেহানা ও তার পরিবারের নামে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে বাংলাদেশ স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পূর্ব পাশে অবস্থিত ১৫-১৬ বিঘার ওপরে আরেকটি বাংলো আছে। যেটার মালিক শেখ রেহানা। প্রতি বছর শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনা একান্তে সময় কাটাতে সেখানে যেতেন। এ ছাড়া সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা মাঝেমধ্যে সেখানে বৈঠক করতেন। এ ছাড়া ফাউকাল ও বাঙ্গাল গাছ এলাকায় শেখ রেহানা ও তার স্বজনদের নামে বাংলো ও ভূসম্পত্তি রয়েছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে একটি বহুতল ভবন রয়েছে তাদের। সেখানে আছে নিটিং কারখানা। ওই কারখানার একজন ম্যানেজার জানিয়েছেন, কারখানার পাশে শেখ রেহানা তার ১০তলা একটি ভবন কিছুদিন আগে বিক্রি করে দিয়েছেন। ভূমি অফিসে এ ব্যাপারে তথ্য জানতে চাইলে তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন পালোয়ান।

এদিকে গাজীপুরে রেহানা পরিবারের বাগানবাড়ি ও বিপুল সম্পদের দালিলিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে কাজ করছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন বলেন, শেখ রেহানা ও তার পরিবারের সম্পদ ও জমির খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এজন্য সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও রাজস্ব বিভাগ থেকে তথ্য এলে বিস্তারিত বলা যাবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। আমাদের কাছে যখন দুদক বা অন্য কোনো সংস্থা আসবে, তখন আমাদের রিপোর্ট করতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের কার্যক্রম চলছে। এটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউএনও ও রাজস্ব বিভাগ কাজ করছে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.




© All rights reserved ©ekusheysylhet.com
Design BY DHAKA-HOST-BD
weeefff